শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:০৯ পূর্বাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক: আজ আমরা আলোচনা করব উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে পুত্র ও কন্যরা কে কতটুকু সম্পত্তি পাবে। ছেলে সন্তানের অবর্তমানে মেয়েরা কতটুকু সম্পত্তি পাবে, কিভাবে সম্পত্তি বন্টিত হবে, এ বিষয়ে আমাদের প্রচলিত আইন, পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহ কি বলে সে সব বিষয় নিয়েই আজকের নিবন্ধ।
শুরুতেই বলে রাখি কন্যারা কিন্তু তিনভাবে পিতা-মাতার সম্পত্তি পেতে পারে। কন্যা হলে তিনি রেখে যাওয়া সম্পত্তির দুই ভাগের এক ভাগ বা (১/২) অংশ পাবে। একাধিক মেয়ে হলে সবাই মিলে সমানভাবে তিন ভাগের দুই ভাগ বা (২/৩) অংশ পাইবে। যদি পুত্র থাকে তবে পুত্র ও কন্যার সম্পত্তির অনুপাত হইবে ২:১ অর্থাৎ এক মেয়ে এক ছেলের অর্ধেক অংশ পাবে। তবে, যাই হোক না কেন, কন্যা কখনো পিতা-মাতার সম্পত্তি হতে বঞ্চিত হয় না।
মুসলিম আইন অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির একজন মেয়ে থাকলে এবং কোনো ছেলে না থাকলে মেয়ে মৃত ব্যক্তির মোট সম্পত্তির অর্ধেক পাবে। যদি একাধিক মেয়ে থাকে এবং ছেলে না থাকে মেয়েরা মোট সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ পাবে এবং এ অংশ সব মেয়েদের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ হবে। বাকি সম্পত্তি অন্যরা পাবে।
একটি উদাহরণ দিয়েই শুরু করি। জনাব রহিম মিয়া মারা যাওয়ার সময় স্ত্রী, এক মেয়ে এবং এক ভাই রেখে যান। মুসলিম আইন অনুসারে তার মৃত্যুর পর তার রেখে যাওয়া সম্পত্তির অর্ধেক তার মেয়ে এবং এক-অষ্টমাংশ পাবেন তার স্ত্রী। সে হিসেবে পুরো সম্পত্তির আট ভাগের পাঁচ ভাগ এ দুজনের মধ্যে বণ্টন হওয়ার পর বাকি আট ভাগের তিন ভাগ আসাবা হিসেবে পেয়ে যাবেন রহিম মিয়ার ভাই। পক্ষান্তরে রহিম মিয়া যদি মারা যাওয়ার সময় স্ত্রী, ভাই এবং এক মেয়ের সঙ্গে একজন ছেলে সন্তানও রেখে যেতেন, সে ক্ষেত্রে সম্পত্তি বণ্টনের হিসাব-নিকাশ অন্যরকম হয়ে যেত। এ অবস্থায় স্ত্রী এক-অষ্টমাংশ নেয়ার পর বাকি আট ভাগের সাত ভাগ তার ছেলে-মেয়ের মধ্যে ২:১ হারে বণ্টিত হয়ে যেত এবং রহিম মিয়ার ভাই সম্পত্তিতে কোনো অংশ পেতেন না। এর অর্থ হলো রহিম মিয়ার মৃত্যুর পর তার ছেলে না থাকলে সম্পত্তির বড় একটা অংশ পরিবারের বাইরে অর্থাৎ তার ভাইয়ের কাছে চলে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে মৃত্যুকালে ছেলে রেখে গেলে তার এ সম্পত্তি পরিবারের বাইরে যাচ্ছে না।
তবে পুত্র সন্তানের অনুপস্থিতির কারণে যে অংশটুকু পরিবারের বাইরে চলে যাওয়ার কথা, সেটুকু অংশ পিতা তার জীবদ্দশায় কন্যাসন্তানের অনুকূলে উইল করে দিয়ে যেতে পারেন। অথবা জীবদ্দশায় কন্যা সন্তানকে সেই অংশটুকু হেবা করে দিতে পারেন। তবে এ দুই উপায়েই বিশেষ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার সম্পত্তিতে যারা নির্ধারিত অংশ পাবেন, তাদের উইল করতে হলে যার অনুকূলে উইল করা হবে, তার সহ-শরিকদের মতামত গ্রহণ করতে হয়। সে হিসেবে কন্যা যেহেতু পিতার সম্পত্তিতে নির্দিষ্ট অংশ পেয়ে থাকে, তার অনুকূলে সম্পত্তি উইল করতে হলে পিতাকে অন্য সহ-শরিকদের সম্মতি গ্রহণ করতে হবে; যা বাস্তবে বেশ কঠিন ব্যাপার।
মনে রাখতে হবে মেয়েকে উইল করে গেলে পুরো সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশের বেশি উইল করা যাবে না। আর উইল কার্যকর হবে উইলকারীর মৃত্যুর পর। আবার জীবদ্দশায় কন্যাসন্তানের অনুকূলে হেবা বা সম্পত্তি দান করারও একটা ঝুঁকি রয়েছে। হেবা সাধারণত তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হয় বলে হেবা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই তার মালিক হয়ে যায় হেবা গ্রহিতা। এখন সম্পত্তি যদি বাবা-মা তার মেয়ের অনুকূলে হেবা করে দেন, সে ক্ষেত্রে বাবা তার জীবদ্দশায় অনিরাপদ বোধ করতে পারেন, কারণ সম্পত্তি তখন আইনগতভাবে আর তার মালিকানায় থাকে না। সম্পত্তিহীনভাবে বাকি সময়টা মেয়ের গলগ্রহ হয়ে পড়ে থাকার ঝুঁকি তাই কোনো বাবা-মা নিতে চান না।
আমাদের পবিত্র কোরআন সূরা নিসায় পুত্রসন্তানের অবর্তমানে কন্যাসন্তানদের জন্য উত্তরাধিকার সম্পত্তির সর্বোচ্চ দুই-তৃতীয়াংশ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্তু পুত্রসন্তান না থাকলে কন্যাসন্তানকে নির্ধারিত অংশ দেয়ার পর বাকি সম্পত্তি কোথায় যাবে, সে ব্যাপারে কোরআন শরিফে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। মূলত হাদিসের মধ্য দিয়ে এ বিধান সাব্যস্ত হয়েছে, যেখানে দূরবর্তী আত্মীয়দের অধিকারও স্বীকৃত হয়েছে। বাবা-মা যদি বুঝতে পারেন যে তাদের মৃত্যুর পর পরিবারের বাইরের সদস্যরা (যাদের উত্তরাধিকার সম্পত্তি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে) কন্যাসন্তানদের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করবেন না, সে ক্ষেত্রে তারা জীবদ্দশায় তাদের মেয়ে সন্তানের অনুকূলে সম্পত্তি হেবা করে যেতে পারেন। এ ক্ষেত্রে জীবনস্বত্ব রেখে মেয়েদের সম্পত্তি হেবা করা হলে তা ইসলামী আইনের পরিপন্থী হবে না বলে মত দিয়েছেন ইসলামী বিশেষজ্ঞরা। কাজেই আপনি পুরো সম্পত্তি জীবনস্বত্ব রেখে মেয়েদের নামে হেবা করে দিতে পারেন।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮